এই মুহূর্তে




ডুবে থাকতেন শ্যামাসঙ্গীতে, খালি যেতেন শ্মশানে, শেষে গলায় দিলেন দড়ি – কেন ?




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায় : ৫৮ বছর কেটে গেছে, তিনি নেই। তবে কালীপুজোতে শ্যামা সঙ্গীতের কথা উঠে এলেই জীবন্ত হয়ে ওঠেন তিনি, কারণ, তিনি ছিলেন শ্যামা সঙ্গীতের দুনিয়ায় কয়েকজন প্রথম সারির শিল্পীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তিনি হলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। তাঁর শিল্পীসত্তার কথা বলতে গিয়ে তাঁর মেজদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য একজায়গায় বলেছিলেন, ‘…ওর গানের যে পারফেকশন, যে ভাব, তা একেবারে ঐশী ব্যাপার। তার গানের মতো মর্মস্পর্শী গান আমি নিজে গাইতে পারি নি। ওর “আমার সাধ না মিটিল” এবং আমার “ডুব ডুব ডুব ডুবসাগরে আমার মন”— এই গানদুটো পাশাপাশি চিন্তা করলেই বোঝা যাবে তফাতটা। আমার সাধ না মিটিল গানটি যেন সমস্ত শরীর ও মনকে নাড়া দেয়।’  হ্যাঁ ঠিকই, আজও পান্নালালের গান শুনলে যে কোনো আবেগপ্রবণ ব্যক্তির চোখেই জল আসতে বাধ্য।

জানা যায়, একটা সময় পান্নালাল ভট্টাচার্য ছিলেন ঘোরতর সংসারী। তবে জীবদ্দশায় তাঁকে বারংবার আকর্ষণ করত শ্মশান। কি খুঁজতে যেতেন তিনি শ্মশানে? সেখান থেকে হঠাৎ করেই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। কী হয়েছিল তাঁর? কেনই বা অকাল বয়সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন পান্নালাল?

১৯৩০ সালে হাওড়ার বালিতে পান্নালাল ভট্টাচার্যের জন্ম হয়েছিল। ১১ ভাই-বোনদের মধ্যে সবথেকে ছোট ছিলেন পান্নালাল। তিনি কখনও নিজের বাবাকে দেখেননি । জানা যায়, তিনি যখন তাঁর মায়ের গর্ভে সাত মাসে পড়েছেন, তখনই তাঁর বাবা মারা গিয়েছিলেন। ফলে বাবা সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুর জন্য পান্নালালকেই দায়ী করেছিলেন তাঁর মা। এরপর পান্নালাল মানুষ হয়েছিলেন নিজের দাদাদের হাতেই। বিশেষত তাঁর মেজদাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর সব থেকে প্রিয়। বলতে গেলে তিনিই নিজের ছেলের মতো করে মানুষ করেছিলেন পান্নালালকে। আর ধনঞ্জয়ের স্ত্রী ছিলেন পান্নালালের কাছে নিজের মায়ের মত।

এরপর মেজদার হাত ধরেই তিনি শ্যামা সঙ্গীতের জগতে পদার্পণ করেন। ধীরে ধীরে পান্নালালের অভূতপূর্ব আবেগী কন্ঠের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।  ভক্তিমূলক গানে তিনি ছাড়িয়ে যান ধনঞ্জয়কেও। তবে তাঁর ধারণা ছিল, মেজদার থেকে ভালো গান আর কেউ গাইতে পারেননা। শোনা যায়, নিজেকে নিয়ে এবং নিজের গান নিয়ে কোনওদিনই সন্তুষ্ট ছিলেন না পান্নালাল । তিনি সব সময় চাইতেন মা ভবতারিণীকে দেখতে। পরিবার সূত্রে জানা যায়, তাঁর দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য নাকি বহুবার মা ভবতারিণীকে দেখেছেন। কিন্তু পান্নালাল কখনই তাঁর ‘মা’কে দেখতে পাননি, এই নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ছিল চিরকালের।

পান্নালালের জীবনে অনেক ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। শোনা যায়, একদিন অনুষ্ঠান শেষে শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি আসার সময় বালি স্টেশনের কিছুটা আগে হঠাৎ করেই ট্রেনের মধ্যে অঝোরে কাঁদতে শুরু করেছিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। সহশিল্পীরা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন, মা ভবতারিণীকে তুঁতে বেনারসি পরানো হয়েছে! কেউ বিশ্বাস না করায়, পান্নালাল চ্যালেঞ্জ ঠুকে বলেছিলেন, তিনি নেমে দেখতে চান। তারপরে পান্নালালের কথায় যখন মানবেন্দ্ৰ মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্রের মতো শিল্পীরা মন্দিরে গিয়ে দেখে একেবারে হতবাক হয়ে যান। সকলেই দেখেন সত্যি সত্যিই  মা ভবতারিণীকে তুঁতে রঙের বেনারসি পরানো হয়েছে। জানা যায়, পান্নালালের ভাইপো ধনঞ্জয়পুত্র দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এক নিবন্ধে তাঁর কাকার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন, “শেষদিকে পান্নালাল প্রায়শই শ্মশানে বসে থাকতেন, আর ‘দেখা দে মা’ বলে হাহাকার করতেন।” পান্নালালের এই হাহাকার যেন ক্রমশ সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। 

পান্নালালের জীবনের শেষ দিকের ঘটনা। জানা যায়, রামপ্রসাদ সেনের লেখা ‘অপার সংসার নাহি পারাপার’ এবং অসিতকুমার বসুর লেখা ‘ওদের মত বলব না মা আমায় তুমি কর পার’ -এই দুটি গান তিনি রেকর্ড করবেন। তখন সময় পেলেই তিনি চলে যেতেন শ্মশানে। ঘরে বসে পান্নালালকে সেই দুটো গান তোলাচ্ছেন ধনঞ্জয়। সুর করেছেন তিনি এবং দাদা প্রফুল্ল ভট্টাচার্য্য। একটা ছোট্ট জায়গা বারবার ভুল করছিলেন পান্নালাল। ব্যাস, কিছুক্ষণের মধ্যেই সাংঘাতিক বকাবকি আরম্ভ করলেন ধনঞ্জয়বাবু। সেই চেঁচামেচি শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন ধনঞ্জয়-ঘরণী। তিন মেয়ের বাপ ছত্রিশ বছরের এক ছেলেকে এইভাবে কেউ বকে? স্ত্রীকে ধমকে তাড়িয়ে দিলেন ধনঞ্জয়। পান্নালাল বরাবরই দাদা-বৌদিকে বাবা-মা জ্ঞান করায় অগ্রজর ধমক সহ্য করতেন নীরবে। দাদা তাঁকে কত ভালোবাসেন তাও জানতেন তিনি। দেখতে দেখতে রেকর্ডিং শেষ হল। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে বাড়ি পর্যন্ত বকতে বকতে এলেন ধনঞ্জয়। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, পানু কেমন গাইল। ধনঞ্জয় বললেন, বাঁদরটার কাছে যা চেয়েছিলাম, তার ষাট ভাগ পেলাম। উত্তরে পান্নালাল বলেছিলেন, সব যদি তোমার মতো পারতাম তাহলে আমিই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য হয়ে যেতাম।

এর মাত্র কয়েকদিন পরের ঘটনা। ২৬ মার্চ, রবিবার, ১৯৬৬ সাল। কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন পান্নালাল। কারণ কী, জানা যায় না স্পষ্ট। সকালে তাঁর ভাইপো অর্থাৎ ধনঞ্জয়বাবুর বড়ো ছেলে শ্যামলাল গঙ্গাস্নান করে এসে দেখলেন তাঁর ছোটোমাসি গোমড়া মুখে বসে। চাপাচাপির পর বললেন, ‘পানু আর নেই!’ ধনঞ্জয় তখন ঘুমোচ্ছিলেন। তাঁকে ঘুম থেকে তুলে দুঃসংবাদ দেওয়া হল । পানু আর নেই শুনে কাঁপতে লাগলেন ধনঞ্জয়। তাঁর পৃথিবী যেন নিমেষে শূন্য হয়ে গেল!   

আকাশবাণীতে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে সেই দুঃসংবাদ। তাঁদের সিসিলের বাড়িতে নিয়ে আসা হল পান্নালালের দেহ ধনঞ্জয়ের স্ত্রী-কে দেখাতে। তিনি তখন খুব অসুস্থ। অনেকে মিলে তাঁকে গাড়ির কাছে ধরে আনতে আছাড়ে পড়লেন পুত্রসম পানুর ওপর। কী অভিশপ্ত সেই দিন!

ধনঞ্জয়বাবু তাঁর ভাইকে দাহ করে বাড়ি ফিরে কেঁদে কেঁদে একটানা বলে চললেন, আয় পানু ফিরে আয় বাবা! আর কোনোদিন তোকে বকব না, ফিরে আয়! তাঁর পুত্রসম আদরের ভাই তখন চলে গেছেন মায়ের কাছে ইহলোকের মায়া কাটিয়ে। মাকে দেখাই যে ছিল তাঁর জীবনে শেষ ইচ্ছা!




Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

মা সেজেছেন দশ হাত-পায়ে, বসিরহাটেই এবার উজ্জয়ণের মহাকালেশ্বর মন্দির

মা কালীকে বিসর্জন দিতে গিয়ে কালীর কোলে বিলীন হয়েছিলেন রামপ্রসাদ 

৪০০ বছর আগে ডাকাতদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এই কালী পুজো

জানুন দক্ষিণেশ্বরে কালীপুজোর মহাভোগে কী থাকছে, রইল বিশেষ প্রণালী

ঘরে উপচে পড়বে ধন-সম্পদ, জেনে নিন দীপাবলিতে লক্ষীপুজোর সময়কাল এবং নিয়ম

সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী মন্দিরে মানত করেন মুসলিমরাও

Advertisement

এক ঝলকে
Advertisement




জেলা ভিত্তিক সংবাদ

দার্জিলিং

কালিম্পং

জলপাইগুড়ি

আলিপুরদুয়ার

কোচবিহার

উত্তর দিনাজপুর

দক্ষিণ দিনাজপুর

মালদা

মুর্শিদাবাদ

নদিয়া

পূর্ব বর্ধমান

বীরভূম

পশ্চিম বর্ধমান

বাঁকুড়া

পুরুলিয়া

ঝাড়গ্রাম

পশ্চিম মেদিনীপুর

হুগলি

উত্তর চব্বিশ পরগনা

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা

হাওড়া

পূর্ব মেদিনীপুর